Book News, লেখক সংবাদ

শামীম আখতার- এর বইপড়ার স্মৃতি

বাবা মায়ের কাছে যার পর নাই কৃতজ্ঞতা আমাদের সুস্থ বেড়ে ওঠার পরিসর দেবার জন্য। তার চাইতে বেশী যা, তারা হাতে ধরে বইয়ের জগৎ এ ঢুকিয়েছিল । আজকের ভোক্তা প্রধান, পণ্য সম্ভারে শোভিত, এতো রকম চাকচিক্যময় সামগ্রীতে ঠাসা সমাজে এখনো বইয়ের দোকানের হাতছানি মন ভোলায়। অনলাইনে আর সব ছাপিয়ে বইয়ের বিজ্ঞাপন চোখ টানে। খুব ছোটো থেকেই গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাতে যাওয়া, অক্ষর জ্ঞান হবার আগেই ম্যাগাজিন কান্না ভোলাতো। কোনো বইয়ে নিষেধ নেই , বড়দের ছোটোদের তারতম্য বুঝেছি অনেক পরে। পড়তে শিখে পৃথিবীর যাবতীয় বই আমার। জুনিয়ার ক্লাসিকের হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসনের ভাবালু করে তোলা রূপকথা, রুম্পাঞ্জেলের লম্বা কেশ টাওয়ার থেকে গড়িয়ে লুটাচ্ছে মাটিতে, বুড়ো আঙুল প্রমাণ থাম্বেলিনা, বুদ্ধদেব বসু যার নামকরণ করেছিলেন আঙুলিনা, সিন্ডেরেলাকে ঘুটেকুড়ানি, বিচিত্র দেশ, বিবিধ সমাজ এক হয়ে আমার কল্পনার অন্য এক জগৎ হয়ে উঠতো। সচিত্র কার্টুনের বইগুলো যতক্ষণ, ততক্ষণ একা লাগার কারণ নেই। খুব ছোটো থাকতেই স্কুলে যাবার আকর্ষণ ছিলো ক্লাসরুমের দেয়ালের ছবির কারণে । খরগোশ লাফিয়ে চলেছে, শ্লথ কচ্ছপ তার পিছে, পরীদের উড়ে চলা, ছবিময়তার মধ্যে ওদেরই একজন হয়ে ওঠা। বাংলা চর্চার জন্য বাবা জসিমুদ্দিনের ডালিম কুমার এনে দিয়েছিলো। এক দিনেই বানান করে পড়ে শেষ। এরপর চটি বই থেকে শক্ত মলাটে উত্তরণ, দেব সাহিত্য কুটিরের পূজা সংখ্যা। স্কুলে রিডিং আওয়ার এক ঘন্টা বাধ্যতামূলক। হয় লাইব্রেরিতে কাটানো নয়তো ক্লাসে বসে লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়া। হার্ড বাউন্ড, ঝকঝকে প্রচ্ছদ আর পরিচ্ছন্ন অঙ্কন। ওই এক ঘন্টা প্রিয়তম সময়, খেলাধূলার চাইতে আনন্দের। জীবনের প্রথম প্রিয় অনুদিত বই, যা আজো অবিস্মরণীয়, রবিনসন ক্রুসো যে বই আমাকে উদ্ভাবন আর এ্যডভেঞ্চারে টেনে নেয়, এরপর লিটল উইমেন যার অনুদিত নাম চার বোন চার মন, আর মার্জারী কিনান রওলিংস এর দ্য গোল্ডেন ইয়ার্লিং বা সোনার হরিণ, এমন একটা বয়স বইগুলোর কে অনুবাদক মন দিয়ে দেখা হয়নি । মিষ্টার ব্ল্যাক আর তার সহযোগী স্মিথ একের পর এক খুন আর জটিল রহস্য ভেদ করছে । ফুলবাড়িয়া স্টেশনে বই পত্রিকার স্টল বাবা যতদিন বেঁচেছিলো কোনোদিন বই হাতে নিলে না বলেনি। মা তখন সুলভ সংস্করণের ঝিনুক প্রকাশনীর বই পড়ে। জাম বেগুনি সস্তা মলাট, নিউজপ্রিন্টের ঘিয়ে পাতায় ছাপা রহস্য উপন্যাস, আশাপূর্ণা দেবী অথবা শরৎ সাহিত্য, বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী দুপুরে মায়ের তন্দ্রালুতার সুযোগে পড়ে ফেলা। বুঝি বা না বুঝি নেশাগ্রস্ত পড়া। বর্ষার রাতে ভুতের গল্প , ঘুম ঘুম পাড়া, অদূরে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ট্রেনের হুইসেল, বাবা অনেক রাত জেগে বই পড়ে, ভাইয়েরা তাদের ঘরে চাপা গুঞ্জনে কথা বলে , মা সারাদিনের সংসার গুটিয়ে ক্লান্ত, বিছানায় শুতে শুতে বলে, বই বন্ধ কর, ঘুমা! কি সহজ একটা সময়। পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে, প্রকান্ড এক সেল্ফ নামাতে দেখে আমি পুলকিত । আসাফ, ইতু দু’ভাই আর বড় এক ফুটফুটে বোন। আসাফের কাছ থেকেই নিয়মিত বই নেয়া । এক বছরের মধ্যেই ওরা বদলী হয়ে যায় চট্টগ্রাম। এরপরেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে একটা লাইব্রেরী গড়ার আয়োজন চলে। যে যার বই দান করবে, কিন্তু জায়গা মেলা ভার। ঠিক হয় বাবার ডিস্পেন্সারির একটু খালি জায়গায় বই রাখা হবে। চাঁদা তুলে বই কেনা হবে, চার আনা সদস্য চাঁদা তুলতে গিয়ে মেজ ভাইয়ের হাতে কান মলা খেয়ে সেই লাইব্রেরী আর হয়নি। বড় হবার পালা শুরু হয়েছে ততদিনে। আমি ঝুঁকেছি বাবার বইয়ের দিকে, এ্যান ফ্রাঙ্ক এর ডায়েরি, সমারসেট ম্যম, হেমিংওয়ে, স্টাইনবেক আরো কত নাম। মেয়েরা কম লেখে মনে হবার সুযোগ কই। বেগম পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন জোবেদা খানম, রাবেয়া খাতুন, মকবুলা মঞ্জুর, হাজেরা নজরুল, রিজিয়া খানম। বাবার সংগ্রহে নাদিন গর্ডাইমার, ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ড, আগাথা ক্রিস্টি। শার্লট ব্রন্টে, জেন অস্টেন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের ঘোর সৃষ্টি করতো । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবাড়ি ওবাড়ি আশ্রয়েও ছোটো ব্যাগটায় ক’খানা স্কুলের বইয়ের সঙ্গে গন উইথ দ্য উইন্ড । স্বাধীনতার পর বই জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এসেছে ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয় সঙ্গে বাংলাদেশের লেখক কবিরা ব্যাপক আলোচিত হচ্ছেন ঘরে ঘরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে হাত খরচ জুটাতে সচিত্র সন্ধানীতে গমন। নির্বাহী সম্পাদক বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় বন্ধু, বোন ঊর্মি রহমান । বেলাল ভাইয়ের নখের ডগায় বিশ্ব সাহিত্য, অবলীলায় তুলে দেন সেই অমূল্য ভান্ডার। নারীবাদী সাহিত্য থেকে প্রবন্ধ ঝুঁকে পড়া , নেরুদার মেমোয়ার্স থেকে শত বর্ষের নি:সঙ্গতা। আমার লেখালিখির শুরু সেই থেকে। বই আমার জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। সে গল্প পরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *