Book News, শুভ জন্মদিন, শ্রাবণ সাহিত্য

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুভ জন্মদিনে পড়ুন তাঁর ৩টি কবিতা

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুভ জন্মদিনে পড়ুন তাঁর ৩টি কবিতা

শুধু কবিতার জন্য

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

তুমি যেখানেই যাও

 

তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি
মন্দিরের পাশে তুমি শোনোনি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি এলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনোনি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে
চুর্ণ অলক?
তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরাত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনি, রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে আমি দেখি
তোমার সুঠাম তনু,ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়
সে এসেছে;
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি
এলাচের দানা জানে, কার ঠোঁট গন্ধময় হবে!
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি
হেসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!

~স্মৃতির শহর ১

আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী
আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার
আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়
মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।
বাতাসে ছেঁড়া মেঘ, চাঁদের চারপাশে
সহসা দানা বাঁধে নীল সময়
বাইরে এসে দেখি পৃথিবী শুন্‌শান্‌
রাস্তাগুলি যেন আকাশময়।
প্রথম ডেকেছিল মধ্য কৈশোরে
পাগল করা এক ব্যথার দিন
শরীরে বেজেছিল সমর বিউগ্‌ল
প্রথম স্বপ্নেরা হলো স্বাধীন।
চক্ষে কেউ নেই তবুও বিচ্ছেদ
পাইনি কেন তাকে চিনি না যাকে
তখন মনে পড়ে নিশীথ-সংকেত
দুরাশা ঘুরে ফেরে নদীর বাঁকে।
শাসন বন্ধন তুচ্ছ হয়ে গেল
আমার চেনা পথ গোলক ধাঁধা
দৃষ্টি বিভ্রম সীমানা ছুঁয়ে যায়
খড়্গে কেটে দিই অলীক বাধা।
এদিকে সোনাগাছি কাচের ঝনঝনি
পেরিয়ে চলে যাই আহিরিটোলা
নতুন স্ত্ৰাণ মাখা শহর কেঁপে ওঠে
পূর্ব পশ্চিমে দুনিয়া খোলা।
এখন জেগে ওঠে কীট ও কুসুমেরা
আঁধার শুষে নেয় দিনের তাপ
জ্যোৎস্না রেণু ওড়ে, ধুলোয় হীরেকুচি
এখন ছুটি নেয় পুণ্য পাপ।
দু’পাশে গলি যুঁজি হোচট লাগে পায়
পল্‌কা সংসার এখানে কার?
জন্ম মৃত্যুর প্রগাঢ় কৌতুকে
হাসি ও কান্নার সারাৎসার।
এ যেন নিশিডাক, মৃতের হাতছানি
এ যেন কুহকের অজানা বীজ
এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়
হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ।
আমাকে যেতে হবে এখনো যেতে হবে
রয়েছে অশরীরী অপেক্ষায়
যেখানে ব্যাকুলতা ঢেউয়ের তালে দোলে
যেখানে ধ্বনিগুলি স্মৃতিকে খায়।
পথের রাজা এক নগ্ন মহাকাল
ধরেছে মুদারায় ডাগর গান হেঁ
তাল দণ্ডটি আকাশে তুলে ধরে
সে যেন নিতে চায় সাগর-ঘ্রাণ।
একটু নিচু হয়ে দিয়েছি সম্মান
আবার সরে গেছি অপর দিকে
পারিয়া কুকুরেরা অবাক চোখে দেখে
গাছের মতো এই মানুষটিকে।
দুদিকে মন্দির, গরাদে ভীমতালা
কালীর স্তনঘেরা পিঁপড়ে রাশি
প্রদীপে মৃদু আলো, সিঁড়িতে বেজে ওঠে
কুণ্ঠরোগিণীর শুকনো কাশি।
একলা শালপাতা আপন মনে ওড়ে
পুজোর গাঁদা ফুল ধুলোয় মাখা
একটি ঘুমাচোখ বালক হিসি করে
দেয়ালে রমণীর শরীর আঁকা।
এবারে দেখা যায় স্মশানে উৎসব
আগুন জবা রং, গুঞ্জরন
ছায়ার কোলাহল, ছায়ার ঘোরাফেরা
ব্যস্ত নিরাকার মানুষজন।
এখানে রাত নেই, এখানে দিন নেই
থেমেছে চুম্বকে আয়ুর ঘড়ি
মৃতেরা হেসে ওঠে, জীবিত উদাসীরা
হেলায় ছুড়ে দেয় পারের কড়ি।
গাঁজার বীজ ফাটে, শিবের শিষ্যেরা
বৃত্তে বসে আছে ছবির প্রায়
যমজ ত্রিভূজের চূড়ায় লাল আলো
জোনাকি ফুটে ওঠে নদীর গায়।
চোখের চেয়ে আরও অনেক বড় দেখা
দৃশ্য ঘুরে যায়, ঘোরে বাতাস
ধোঁয়ার মৃদু জ্বালা শোকের রলরোল
বাষ্প-অশ্রুতে রুদ্ধশ্বাস।
জলের কাছে যাই, সেখানে কেউ নেই
সেখানে শুয়ে আছে নদীর কায়া
আমাকে ডেকেছিল স্বপ্ন ছেড়া এক
পাহাড়-কুন্তলা গভীর ছায়া।
ছায়াও জেগে ওঠে জলের সশরীর
শহর বিস্মৃত আকাশলীনা
আমার করতল দেয় ও নেয় কিছু
জীবন কেটে যায় তাকে ভুলি না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *